♥-অদ্ভুত প্রেমের গল্প-♥
পর্ব------১৭\১৮
রীতার চাকরি হয়েছে। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে। এরা বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো পার্টি থেকে বড়সড় কর্পোরেট সেমিনার এরেঞ্জ করে। রীতা এখানে একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে জয়েন করেছে।
চাকরীটা রীতার খুব দরকার ছিল। বাসায় থাকতে থাকতে সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আর অফিসটাও তাঁর খারাপ লাগছে না। সবাই বেশ হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। অফিস এর পর প্রায়ই এখানে ওখানে খাওয়া দাওয়া হয় দল বেঁধে। এটাও কাজেরই অংশ। এ এক অন্য স্বাদ। নিজেকে সে অন্যভাবে আবিষ্কার করছে। আগে রীতার জীবন ছিল ভার্সিটি আর বাসা। তাও এর মাঝে ছিল মায়ের কড়া অনুশাসন। ঠিকভাবে যেন নিশ্বাস ফেলা যেত না। ক্লাস এর অন্যান্য মেয়েরা ঢাকার বাইরে থেকে এসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করত। আর রীতা ঢাকার মেয়ে হয়েও সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি পেত না। এই চাকরীটা হচ্ছে রীতার বড় হওয়ার সার্টিফিকেট। কারণ মা নাজমা হক মেয়ের চাকরী করার বিপক্ষে নন। বরং মনে মনে চাইতেন মেয়ে চাকরী করুক। চাকরী করলে নিজের পায়ের মাটি শক্ত হয়। নিজে চাকরী করতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর মনে আক্ষেপ আছে। তবে জীবনের আর বড় বড় আক্ষেপের চেয়ে এই আক্ষেপ নগণ্যই বলা যায়। সুতরাং মেয়ে চাকরী করছে এতে নাজমা হক খুশি। মায়ের খুশি রীতার জন্য অলিখিত সার্টিফিকেট। নইলে সে মনে শান্তি পায় না। যেমন পুলকের ব্যাপারটা নিয়ে সে অনেক অশান্তিতে আছে। বেশ অনেকদিন সে বাসায় এ নিয়ে চিন্তা করল। কতকিছু কতভাবে চিন্তা করল। কিন্তু কিছুতেই কোন কূলকিনারা পেল না। একটা সময়ে এসে সে এটা নিয়ে ভাবনা চিন্তাই বন্ধ করে দিল। যা হোক হবে!! আর ভালো লাগে না। কপালে যদি থাকে তাহলে পুলকের সাথে তাঁর বিয়ে হবে। নয়তো হবে না। তখনই চাকরীটা যেন তাঁকে আরো সাহায্য করলো। এখন সে অফিস এর সময়টা কাজ করে উপভোগ করে কাটিয়ে দেয়। আর বাসায় গিয়ে খুশি মনে সবার সাথে অফিসের গল্প করে, মাকে কাজে সাহায্য করে আর ছোট বোন রীতার সাথে খুনসুটিতে মাতে। হ্যাঁ, পুলকের সাথে আলাপ কমে গেছে। ফেসবুক এ নয়তো এসএমএস এ। ফোনে অফিস এ টুকটাক। বাসায় আসলে তো আর ফোনে কথা বলার যো-ই পাওয়া যায় না। পুলকের ঘটনা জানার পর থেকে মা ফোন আসলেই সরু চোখে তাকায়। তাই পুলকের সাথে কথা এসএমএস এই বেশি হয়। পুলক এ নিয়ে কোন অভিযোগ করে না। অন্যায় রাগ পুলকের মধ্যে নেই বললেই চলে। হ্যাঁ, এখন যদি রীতা সিনেমা দেখতে গিয়ে পুলকের সাথে কথা না বলে তাহলে পুলক মহাশয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। ঝগড়াঝাঁটি করে এক সা করবে। সেই রাগ কবে ঠাণ্ডা হবে রীতাও জানে না। প্রথম প্রথম এ ধরনের রাগ ঠাণ্ডা হতে ২-৩ দিন সময় লাগত। কিন্তু যেখানে আসলেই সমস্যা। সে বেলায় পুলক সব সময়ই আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সামনে মা। পুলকের এসএমএস এর জবাব দেয়া যাচ্ছে না। শুধু একবার কোনাভাবে শুধু এসএমএস করলেই হবে যে '‘মা'’। ব্যাস!!! আর কিছু না! পুলক আর এ নিয়ে কোন সমস্যাই করবে না। মাঝে মাঝে রীতার মনে হয় সে পুলককে ঠকাচ্ছে। রীতার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে সে পুলককে আরো কত সময় দিত। রীতা তো আর তা দিতে পারে না।
পুলক বেশ খুশি হয়েছে রীতার চাকরি পাওয়াতে। রীতা বাসায় থেকে থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। ওঁর জন্য খুব দরকার ছিল অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। পুলক এখন আর রীতাকে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে না। সে বুঝতে পারে রীতা এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ডিস্টার্বড। আরো একটু সময় যাক। রীতার অস্থিরতা কমুক। রীতাকে অস্থির দেখলে তাঁর ভালো লাগে না। রীতার যে কোন সমস্যা তো তারই সমস্যা। রীতার চাকরী পাওয়াতে পুলক ভেবেছিল এখন থেকে তাঁর আর রীতার বেশ ঘন ঘন দেখা হবে। এটা ভেবেও সে খুব খুশি হচ্ছিল। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না। লাঞ্চ টাইম এও রীতা সময় করে বের হতে পারে না। অফিস এর পর যাও দুএক দিন দেখা হয় তখন রীতার বাসায় যাওয়ার খুব তাড়া থাকে। দেরী হলে মা বকবে। পুলক মেনে নেয়। একটু একটু অভিমান জমতে চাইলেও সে জমতে দেয় না। বাসায় সমস্যা হলে রীতারই মন খারাপ হবে। রীতার মন খারাপ হোক এটা সে চায় না।
কখনো চায় না......
--চলবে.....
পর্ব-----১৮
‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নামে মুনীর চৌধুরীর একটা নাটক আছে। নাটকের একটা সংলাপ খুব জনপ্রিয়। সংলাপটা মানুষ কারণে অকারণে ব্যবহার করে। ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’। এখন মানুষ যে বদলায় এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মানুষ কখন বদলায়? মানুষ বদলায় পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে। জেলে বন্দি থাকা মানুষ এক রকম। সেই একই মানুষ মুক্তি পেলে অন্য মানুষ। দুঃখে থাকা মানুষ এক রকম। আবার সেই একই মানুষ দুঃখ কাটিয়ে উঠলে অন্য মানুষ। পরিস্থিতি বদল। মানুষ বদল। নিজের বদলে যাওয়া সম্পর্কে মানুষ নিজেই অবগত না। কারণ পরিস্থিতির বদলে যাওয়া সম্পর্কেও মানুষ আগে থেকে বলতে পারে না। এমতাবস্থায়, আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারি যে মানবজাতি একটি অননুমেয় জাতি।
চাকরীর আগে রীতার জীবন ছিল অসম্পূর্ণ। সেই অসম্পূর্ণ জীবন পূর্ণ হয়েছিল পুলকের মত একজনকে পেয়ে। যে তাঁর জীবনের সব সমস্যাগুলোর ভার নিয়ে নিয়েছিল। রীতার কষ্ট হলে রীতা সেই কষ্টের ভারটা পুলকের কাঁধে রেখে হাল্কা হতে পারত। তাঁর তথাকথিত বন্দি জীবনে পুলকই ছিল আশ্রয়।
এরপর চাকরী পাওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল। রীতার সামনে খুলে গেল নতুন জগৎ। যে জগতে পুলক আর তাঁর মা ছাড়াও বহু লোক আছে। যে দুনিয়াতে সময় কাটালে সব দুশ্চিন্তা ভুলে থাকা যায়। ততদিনে ‘পুলক’ নামক ব্যক্তিও তাঁর দুশ্চিন্তার তালিকার মধ্যে ঢুকে গেছে।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একজন থাকে যার অনুমোদন ছাড়া সামনে এগোতে ঠিক সাহস হয় না। মনে যেন একটা কামড় লেগে থাকে। হতে পারে সেই মানুষটি আমাদের মা-বাবা, বন্ধু অথবা এর চেয়েও কাছের কোন মানুষ। কিন্তু এই কাছের মানুষের সংখ্যা যদি একের বেশি হয় আর তাঁদের মতামত যদি একই রকম না হয় তখন হয় একটি বিরাট সমস্যা।
রীতার কাছে পুলক আর তাঁর মা এরকমই দুজন মানুষ। যাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাই সে এসব থেকে যতদূরে থাকা যায় থাকছে। অফিস করে দেরী হলেও মা এখন আর তাঁকে কিছু বলে না। এখন মেয়ে জব করে। মেয়ে বড় হয়েছে। তাও মেয়েকে জিজ্ঞেস করে-
-কীরে!! এত দেরী কেন?
-ওই শেষ দিকে আরিফ ভাই প্ল্যানিং এর ডিটেইলস জানতে চাইল। তারপর সবাই মিলে FFC তে কফি খেলাম। তাই দেরী হয়ে গেল।
নাজমা হক কিছু বলেন না। তবে তাঁর মাঝে কোন অসন্তোষ দেখা দেয় না। অফিস এর কলিগদের সাথে হাল্কা মেলামেশা তাঁর কাছে দোষনীয় মনে হয় না। খালি মৃদু স্বরে একবার বলেন-
-ভালো!!! অন্য কিছু না করলেই হলো।
কথাটা রীতা শুনেও না শোনার ভান করে চলে যায়।
যতক্ষণ মেয়ে পুলক নামক ছেলেটার থেকে দূরে থাকবে ততক্ষণ তাঁর কোনকিছুতেই আপত্তি নেই।
পুলকও আস্তে আস্তে রীতার পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছে। সে রীতাকে বোঝার চেষ্টা করছে। এমন একটা সময় ছিল যখন পুলককে কেউ মেনে নিতে পারত না। পুলকের মনে হত তাঁর জন্য এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে তাঁকে বুঝবে। সেই সময় রীতা তাঁর জীবনে এসেছিল। সে যেমন তেমন করেই। এখনকার পুলক আর আগের মত চট করে রেগে যায় না। সে বড় হয়েছে। এই ‘বড়’ সে হয়েছে রীতার সহযোগিতায়। সে এখন ঘটনার পিছনের ঘটনা বোঝার চেষ্টা করে।
রীতার সাথে তাঁর আজকাল ওইভাবে ফোনে কথা হয় না। এমন না যে আগেও খুব হত। কিন্তু এটা নিয়ে কখনোই পুলকের অভিযোগ নেই। বাসায় সমস্যা হচ্ছে। যখন রীতা সুযোগ পাবে তখন ফোন করবে। এটা নিয়ে অশান্তি করার তো কিছু নেই। হ্যাঁ, বাইরে আগে দেখা হত ভালই যখন রীতার ক্লাস থাকত। এরপর তো রীতা আর বাইরে তেমন বের হত না। তাই দেখাও হত না। এটা নিয়েও কেন জানি পুলকের তেমন অস্থিরতা ছিল না। এই পুরো সম্পর্কটাতেই পুলকের মধ্যে একটা নিরাপত্তাবোধ ছিল। ‘নিরাপত্তাবোধ’ শব্দটার বদলে আমরা যদি ইংরেজি শব্দ ‘secure’ ব্যবহার করি তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝা যাবে। এরপর পুলকের কথা রীতা ওঁর মাকে বলল। এতে মাসখানেক রীতার খুব খারাপ সময় গেল। সৌভাগ্যবশত রীতার চাকরিটা হয়ে গেল।
কিন্তু এখন মাঝে মাঝে দেখা হলেও রীতাকে কেমন যেন অচেনা লাগে। এ যেন তাঁর আগের রীতা নয়। আগে রীতা অনেকদিন দেখা না হলে অস্থির হয়ে যেত। দেখা হওয়ার পর খুশিতে কিছুটা আবেগী হয়ে যেত। অনেকক্ষণ হাত ধরে বসে থাকত। কিন্তু এখন কোথাও যেন কিছু একটা গরমিল আছে। কিছু একটা নেই। কি নেই!!! সেটাই পুলক ধরতে পারছে না। পুলক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রীতাকে কত কিছু জিজ্ঞেস করে। এটাও নতুন। আগে রীতাকে তাঁর এত কিছু জিজ্ঞেস করা লাগত না। রীতা নিজে থেকে তাঁকে সব বলত। মাঝে মাঝে পুলক একটু হতাশ হয়ে যায়। হতাশা থেকে আসে রাগ। নিজেই নিজের রাগকে প্রশমিত করে। প্রশমিত রাগ থেকে আসে স্থবিরতা। সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
আজকাল রীতার বাইরে বেশ পার্টি থাকে। সেরকমই এক পার্টি হচ্ছে পিজা হাট এ। পুলক রীতাকে ফোন দিল।
-হ্যালো!!
-হ্যাঁ, বল।
-কোথায় তুমি?
-আমি একটু পিজা হাট এ। অফিস এর কলিগদের সাথে আছি।
-আমি যে আজকে তোমার সাথে দেখা করতে চাইলাম। তুমি তো বললে আজকে বাসায় তাড়া আছে।
-হ্যাঁ ছিল। বাসায় বলে দিয়েছি ফোন করে যে আসতে দেরী হবে।
রীতার স্বর ঠাণ্ডা। কোন অপ্রস্তুতকর ভাব নেই গলায়। যেন এটাই স্বাভাবিক। পুলকের খুব রাগ হওয়ার কথা ছিল। খুব চেঁচানোর কথা ছিল। রাগে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রীতার ঠাণ্ডা নিঃস্পৃহ গলায় পুলক যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেল। কার কাছে রাগের দাবি জানাবে!! এ তো তাঁর চেনা কাউকে মনে হচ্ছে না। এ অন্য কেউ। ‘ও আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিল। শুরু হল পুলকের অভিমান জমা।
প্রিয় মানুষকে খুব বেশী অভিমান করতে দেওয়া উচিৎ না। কারণ একটু একটু করে অভিমান জমে পাহারসম অভিমান জমা হয়। সেই পাহাড় সরানোর ক্ষমতা আমাদের আর থাকে না।
রীতা জানে এসব। সে জানে সে পুলকের সাথে ঠিক করছে না। কিন্তু তাঁর জীবনের এত জটিলতা আর ভালো লাগছে না। সে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি চায়। যেখানে তাঁকে পুলক আর তাঁর মায়ের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিতে হবে না। যেখানে তাঁর কোন মানসিক অশান্তি থাকবে না। একমাত্র কাজের মধ্যে, কাজের মানুষদের সাথে থাকলে সে এসবকিছু ভুলে থাকতে পারে। তাই সে যতক্ষণ পারে বাইরে কাটায়। এতে করে যে তাঁর আর পুলকের মধ্যেকার সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটাও সে বুঝতে পারছে। কিন্তু তাঁর কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করছে না। পুলক অভিমান করে আছে। একটা ফোন করলেই পুলকের সব রাগ অভিমান পানির মত গলে যাবে। সব জানে সে। কিন্তু রীতার কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করছে না। কেন করছে না। তাও সে জানে না।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে পুলক রীতাকে কোন ফোন দেয় না। রীতা মাঝে মাঝে পুলককে ফোন এসএমএস করে। পুলক খুব ফরমালি রিপ্লাই করে। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু পুলক বেশিক্ষন এই মাইন্ড গেম খেলতে পারলো না। পুলক সেই মানুষদের দলে যারা মনের ভিতর রাগ অভিমান জমিয়ে রাখতে পারে না। যখন রাগ হল চিল্লাচিল্লি করে ঠাণ্ডা। রীতার সাথেও তাই করত। কিন্তু এখন তো তাঁর রাগ অভিমানকে রীতা বুঝতেই পারছে না। নাকি বুঝতে চাইছে না।
পুলক রীতাকে একটা মেইল করল.....