Friday, October 26, 2018

অদ্ভূত প্রেমের গল্প পর্ব ৭-৮

No comments

♥-অদ্ভুত প্রেমের গল্প-♥

পর্ব------৭/৮

এরপর খুব অদ্ভুতরকমভাবেই পুলক আর রীতার মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল। আপাতত সম্পর্কটিকে বন্ধুত্ব বলতে পারি। রীতা ক্লাস করে বাসায় এসে অপেক্ষা করে কখন পুলক আসবে আর তারা ফেসবুক এ চ্যাট করবে। ফেসবুক এ চ্যাট ছাড়া তারা ফোনেও কথা বলে। বলা বাহুল্য যে পুলক কে আবার নতুন করে রীতাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে হয়েছিল ফেসবুক এ। দুইজনই তাঁদের বাসায় বলে দিয়েছে যে আপাতত তারা বিয়েতে আগ্রহী নয়। পুলকের মা এতে কিছুটা রাগ করেছে। রীতার বাবা সবসময়য়ই মেয়ের সিদ্ধান্তকে মূল্য দিয়েছে। কিন্তু রীতার মাও বেশ রাগ করেছে। দুই পরিবারের কোন পক্ষই জানে না যে পাত্র-পাত্রির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।

রীতা আর পুলকের মধ্যে আপাতত অভ্যস্ততার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পুলকের এখন আর তেমন একা আর দুঃখী লাগে না। সে অফিস করে। বাসায় এসে ফোনে বা ফেসবুক এ রীতার সাথে গল্প হয়। এখন সে রীতাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। রীতা কিন্তু তাকে ‘আপনি’ ই বলে। এই ‘তুমি বলা’ অন্তরঙ্গতার চেয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পাওয়া অধিকার।

এরমধ্যে রীতা জেনে গেছে যে পুলকের কোন বান্ধবী নেই। এতে সে মনে মনে কিছুটা খুশি। তারপরও সে বাসায় ইতিবাচক কিছু জানায়নি। তার কারণ সে এত জলদি বিয়ে করে ফেলতে চায় না। আর এখন সময়টা তার খুবই ভালো যাচ্ছে। পুলক নামের এই পাগল কিসিম লোকটার সাথের এই সম্পর্কটা সে আরো কিছুদিন এইভাবে উপভোগ করতে চায়। এই লোকটা খুব সহজে রেগে যায়। প্রথমদিকে তো সে বুঝতেই পারতো না যে লোকটা কখন কোন কারণে রেগে যাচ্ছে। যেমন একবার কথায় কথায় সে পুলককে ‘বেকুব’ বলেছিল। এমন সিরিয়াস কিছু না। ঠাট্টা করে। সেই জন্য এই লোক তার সাথে দুই দিন ঠিকমত কথা বলেনি। অনেক কষ্টে সে এই রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছিল। এখন সে মোটামুটি বুঝতে পারে কোন কথায় কখন তার মুড এক্কেবারে আকাশ কালো করা হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণ বুঝা সহজ। গলার স্বর পরিবর্তন হয়। কথাবার্তা দুই-এক শব্দে শেষ করার প্রবণতা দেখা দেয়। এই তো!!

রীতা মাঝে মাঝে পুলকের কথা তার দুএকটা বান্ধবীকে বলে।

রেহানা নামে তার এক বান্ধবী বলল- বাবারে বাবা! এত দেমাগ!! এত দেমাগ তুই পাত্তা দেস কিভাবে? সুজনকে তো আমি আঙ্গুলের উপর রাখি। বসতে বললে বসে, উঠতে বললে উঠে।

কিন্তু এরকম অঙ্গুলিহেলনে চলা ছেলে রীতার পছন্দ না। ছেলে মানুষের কিছুটা আত্মসম্মান, কিছুটা পৌরুষময় রাগ থাকাটা তাকে আকর্ষণ করে।

যদিও পুলক আর রীতা আপাতদৃষ্টিতে প্রেমিক প্রেমিকা নয়। কিন্তু তারপরো রীতা অন্য কোন ছেলের কথা বললে পুলক নতুন প্রেমিকের মতই ফুঁসে ওঠে। একটা কথোপকথন এর বর্ণনা দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

-জানেন!! আজকে না দারুণ একটা ঘটনা ঘটেছে।

-কি ঘটনা? আজকেও তোমার কোন বান্ধবী আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে!!! হাহাহা!!

-আরে না! রোজ রোজ কি মানুষ আছাড় খায় নাকি!! ওইদিন বৃষ্টি ছিল দেখে উপমা টাল সামলাতে পারেনি।

-যাই বলো!! তাই বলে ওইরকম একটা দশাসই শরীর নিয়ে স্যার এর গায়ের উপর পড়ে যাওয়া। হাহাহাহাহাহা।

-হাহা ভেরী ফানি।

-বল কি দারুণ ঘটনা ঘটেছে।

-আজকে এত সুন্দর একটা ছেলে বাইক নিয়ে ইউনিভার্সিটি তে আসছিল!! আমরা তো একেকজন দেখে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।

-(গলা চড়ে গেলো)তোমাদের কাজই তো এই। রাস্তায় যাকে তাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাও। তোমাদের কোন রুচিবোধ নেই। তোমার সাথে তো আসলে আমার কথা বলাই উচিৎ না।

-(হাসি চেপে)কেন? আমি আবার কী করলাম?

-(গলার স্বর চড়া)কিছু না। এখন আর কথা বলব না।

-না আমার কথা তো শেষ হয়নি। কথা শেষ না হলে ফোন রাখতে পারবেন না।

-(জোর করে গলা স্বাভাবিক করে) ওকে!! শেষ কর।

-ছেলেটা যখন কাছে এসে বাইক পার্ক করলো। তখন দেখলাম যে ছেলেটা আসলে বেশী সুন্দর না।

-(নরম স্বরে) হুম!!

ফোনের অপর প্রান্তে থাকা রীতার তখন খুব এই বোকা পাগল লোকটাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছা হলো।

পুলক যে ভিতরে ভিতরে রীতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কিন্তু এটা সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার অন্যতম কারণ হলো যে সে যেরকম ঠিক সেভাবেই তাকে রীতা গ্রহণ করতে পারছে। এটা খুব কম ক্ষেত্রেই পুলকের জীবনে ঘটেছে। স্বাভাবিক কথা বার্তাতেই মানুষকে ভড়কে দেওয়ার একটা প্রবণতা তার থাকে। এতে অনেকেই তাকে ভুল বোঝে। যেমন একবার ফেসবুক এ একটা মেয়ে তাকে তার মায়ের শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলো।

-আপনার মা কেমন আছেন?

-বেচে আছে। এখনো মরে নাই।

এরপর থেকে ওই মেয়ে আর তার সাথে কথা বলে না। পুলকও বলে না। এটা পুলকের এক ধরনের টেস্ট। কিন্তু রীতাকে সে এই টেস্ট করেছে। রীতা কখনোই তাকে জাজ করে না। যেমন ওইদিনই কথা হচ্ছিল।

পুলক বলল

-মায়ের শরীরটা ভালো না।

-কি হয়েছে আন্টির?

-হাটু ব্যথা। শরীর নাড়াচাড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোন দিন পট করে মরে যাবে। বয়স তো ষাট হয়ে গেলো।

-আপনি যে এরকমভাবে কথা বলেন মানুষ আপনাকে ভুল বুঝবে।

-কি রকমভাবে বলি!!

-মায়ের কথা কেউ এইভাবে বলে?

-আমি বলি।

-আপনি সবাইকে দেখান যে আপনি খুবই কঠিন। কিছুই আপনাকে স্পর্শ করে না। কিন্তু এটা তো সত্যি না।

পুলক ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে। এভাবে তো কেউ তাকে বোঝেনি। পুলকের মা পুলককে চেনে। ছেলে ঠাট্টার স্বরে অনেক কথা বলে। আবেগ দেখানো একদম পছন্দ করে না। পুলক কখনো মাকে জন্মদিন উইশ করে না। কিন্তু জন্মদিনের জন্য ঠিকই কিছু না কিছু কিনে আনে। ভাব করে এমন যে এমনেই কোন কারণ ছাড়াই দিচ্ছে।

কিন্তু রীতা তো এসব জানে না। তাও কিভাবে সে এসব বুঝতে পারে।

একটা অদৃশ্য হাত যে সে রীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তা সে ক্ষণে ক্ষণেই টের পাচ্ছে।

পুলক আর রীতার এখন মাঝে মাঝে দেখাও হয়। শনিবারে রীতার ক্লাস থাকে। পুলকের অফিস ওইদিন বন্ধ। তো রীতার ক্লাস এর পর ওরা দেখা করে। একটু ঘুরা ফিরা, গল্প আড্ডা চলে। যদিও রীতা বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকার অনুমতি নেই তার বাসা থেকে। তাতে পুলকের কোন অভিযোগ নেই। যতটুকু সময় কাটায় ওটাতেই সে খুশি থাকে।

রীতার ক্লাস দুইটা পর্যন্ত চলে। পুলক ক্যাম্পাসে চলে যায় ২টার মধ্যে। মাঝে মাঝে এরকমও হয় যে রীতা ক্লাস না করে পুলককে ফোন দেয় আগে আগে চলে আসার জন্য। ওর নাকি ওইদিন ক্লাস করতে ভালো লাগছে না। পরীক্ষা না থাকলে দেখা যায় শনিবার দিনটা পুরোটাই ওরা একসাথে কাটাতে পারে। দুইজনই মনে মনে শনিবারের জন্য অপেক্ষা করে। বলে রাখা ভালো যে এখনো তাদের প্রকাশ্য সম্পর্ক শুধুই বন্ধুত্ব।

সারাদিন ঘোরার পর পুলক তাকে রিকশা করে দেয়। তারা কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলে না। কেউ কাউকে স্পর্শও করে না। কিন্তু তারপরও এই তথাকথিত বন্ধুত্বের বাইরেও একটা সম্পর্কের আবহকে তারা অগ্রাহ্য করতে পারে না। চোখে চোখে বহু কথা হয়ে যায় যা মুখে হাজার বার বলেও বোঝান যায় না। অন্যদের কাছে এই ব্যাপারটা যথেষ্ট ড্রামাটিক মনে হলেও ওদের কাছে মনে হয় এই তো স্বাভাবিক।

যাই হোক!! সম্পর্কের কিছু নতুন দিক আছে। রীতা পুলককে এখন তুমি সম্বোধন করে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে এসেছে এটা দুইজন ঠিকই জানে। কিন্তু ভাব করে এমন যে এটাই স্বাভাবিক।

আরও কিছু নতুন দিক আছে। যেমন আগে খালি পুলক রাগ করতো। এখন মাঝে মাঝে রীতাও রাগ করে। তবে তাঁর রাগ অযৌক্তিক রাগ না। যেমন পুলকের মেজাজ খারাপ হলে সে বেশীরভাগ মানুষের সাথেই উগ্র আচরণ করে। এই তো সেদিন পুলকের অফিস এর এক কলিগের সাথে দেখা ওদের। কোন কারণে পুলক একে দেখতে পারে না। তো সেই লোক চিরাচরিত ভণিতামূলক সামাজিকতা রক্ষার জন্য পুলকের সাথে অনেক বেশী সামাজিক কথাবার্তা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পুলক ভান করতে একদমই ভালোবাসে না। সে মোটামুটি লোকটাকে পাত্তাই দিল না। এখন এদিকে রীতা খুবই অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই লোক তো আর তাঁর পরিচিত না যে সে সামাজিকতাটা রক্ষা করবে। পরে বেচারা লোকটা নিজেই বিদায় নিয়ে চলে যায়।

-ঘটনাটা কী হল?

-কী ঘটনা?

-তোমার অফিস এর কলিগ। তুমি তাঁর সাথে ঠিকমত কথাই বললা না!!

-এরকম ধামাধরা লোকদের সাথে আমি কথা বলি না। এ একটা বিশ্ব ধামাধরা চামচা। সারাক্ষণ বসের পিছে পিছে ঘুরে আর এর ওর নামে বদনাম করে। অথচ সামনে দেখা হলে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।

-যেটাই হোক। উনি না হয় এরকম। তাও তুমি কেন এরকম ব্যবহার করবা?

-বাঃ! তাও তুমি ওর সাপোর্ট নিচ্ছ!!!

-আমি মোটেও ওর সাপোর্ট নিচ্ছি না। ও আমার কেউ লাগে না। কিন্তু আমি চাই না তোমাকে কেউ খারাপ জানুক, খারাপ বলুক।

-দেখ রীতা!! এই লোক দেখানো ভাল আমি কখনো হতে চাই না। এই ভদ্রতার মুখোশে থাকা লোকজনদের দলে আমি যেতে চাই না।

-আমি জানি যে তুমি লোক দেখানো না। কিন্তু আমি চাই না তুমি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার কর। ব্যাস!! এই নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না।

-না এটা তো হলো না। তুমি লজিক এ আস।

-কোন লজিক ফজিক না। তুমি যদি এরপরো এরকম কর। তাহলে খুব খারাপ হবে।

পুলক ভিতরে ভিতরে রীতাকে ভয় পায়। কারণ রীতা তাঁর মত হুট হাট রাগ করে না। তাঁর রাগের পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। আর এই ধরনের রাগ সহজে যায়ও না। তাই সে এরকম পরিস্থিতিতে রীতার কথাই মেনে নেয়।

যথারীতি রীতাকে রিক্সা করে দিচ্ছে পুলক। তাঁদের দুইজনের বাসা দুইদিকে। রীতাকে উঠিয়ে পুলক নিজের বাসায় যাবে।

-এই রিকশা যাবেন?

-কই যাইবেন?

-মৌচাক।

-১০০ টাকা

-কি?????????????

আকাশ থেকে যেন গরম কড়াইয়ে পড়ল পুলক। রাগে তাঁর মনটা চাচ্ছে বেটার মাথায় একটা গাঁট্টা মারে। সে তাকে ভদ্র ভাষায় তুই তোকারি মুলক কিছু কথা বার্তা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দেখল যে রীতা তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পুলক হাত মুঠ করে রিকশাওয়ালার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে অন্য রিকশার খোঁজে গেলো।

রীতা নিজের মনে হাসতে লাগলো। এই পাগলকে সে কাছ ছাড়া করতে পারবে না......

No comments :

Post a Comment